Summary
পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকার খাদ্যবস্তু রয়েছে, যা মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: অজৈব ও জৈববস্তু।
জৈববস্তু যেমন শর্করা, প্রোটিন, চর্বি আমাদের জীব থেকে পাওয়া যায় এবং এগুলো খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। খাদ্য ও পুষ্টির মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে; পুষ্টি হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া যা খাদ্যকে ভেঙে দেহের গ্রহণযোগ্য উপাদানে পরিণত করে।
এই অধ্যায়ে আমরা খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে বিশদ জানতে পারব এবং অধ্যায় শেষে খাদ্য ও পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা, বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের কাজ, এবং সুষম খাদ্যের তালিকা প্রস্তুত করতে পারব।
আমরা পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকার খাদ্যবস্তু দেখতে পাই। এই খাদ্য বস্তুগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-অজৈব ও জৈববস্তু। শর্করা, প্রোটিন, চর্বি বা স্নেহ ইত্যাদি আমরা জীব থেকে পাই। এগুলো জৈববস্তু। এ বস্তুগুলো আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি। খাদ্য ও পুষ্টির সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। পুষ্টি হচ্ছে প্রতিদিনের একটি প্রক্রিয়া, যা জটিল খাদ্যকে ভেঙে সরল উপাদানে পরিণত হয়ে দেহের গ্রহণ উপযোগী হয়। এ অধ্যায়ে আমরা খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে বিশদ জানতে পারব।

এই অধ্যায় শেষে আমরা
- খাদ্য ও পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব।
- বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের কাজ বর্ণনা করতে পারব।
- সুষম খাদ্যের তালিকা প্রস্তুত করতে পারব।
# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন
প্রীতমের গলা দিনে দিনে ফুলে যাচ্ছে। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার একটি বিশেষ রোগের কথা জানালেন এবং সামুদ্রিক মাছ বেশি করে খাওয়ার পরামর্শ দিলেন।
খাদ্য কী? হাঁটা চলা, বাগানে কাজ করা, কুয়া থেকে পানি তোলা, কাঠ কাটা, মাছ ধরা, সাঁতার কাটা বা ফুটবল খেলা ইত্যাদি কাজ করার পর আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং আমাদের ক্ষুধা পায়। আমরা তখন কী করি? আমরা খাবার খাই। খাবার খাওয়ার পর আমরা কী রকম বোধ করি? শক্তি ফিরে পাই। খাদ্য আমাদের শক্তি দেয় ও কাজ করার ক্ষমতা জোগায়।
মানবদেহের গঠন, বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ, রক্ষণাবেক্ষণ, কাজের ক্ষমতা অর্জন, শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদির জন্য খাদ্য প্রয়োজন। দেহের কাজকর্ম সুষ্ঠুরূপে পরিচালিত করে, দেহকে সুস্থ ও কাজের উপযোগী রাখার জন্য যে সকল উপাদান প্রয়োজন, সেসব উপাদান বিশিষ্ট বস্তুই খাদ্য।
খাদ্য আমাদের শক্তি জোগায়, ক্ষয়পূরণ করে ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আমরা বেঁচে থাকার জন্য খাবার খাই।
পুষ্টি কী?
আমরা প্রতিদিন আমাদের চাহিদামতো চাল, ডাল, আটা, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, তরিতরকারি ও কাঁচা ফলমূল খেয়ে থাকি। এ খাবারগুলো সরাসরি আমাদের দেহ গ্রহণ করতে পারে না। এই জটিল উপাদান সমৃদ্ধ খাবারগুলো আমাদের পৌষ্টিকতন্ত্রে পরিপাক বা হজম হয়ে দেহে গ্রহণের জন্য শোষণ উপযোগী সরল উপাদানে পরিণত হয়। রক্তের মাধ্যমে জীবকোষ এই সরল উপাদানগুলো শোষণ করে নেয়। এই পরিশোষিত ও দেহকোষে জমাকৃত খাদ্য উপাদান দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ, শক্তি উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় পুষ্টি। খাদ্য আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করে ও কাজ করার শক্তি জোগায়। আমাদের দেহে খাদ্যের নানা রকম কাজ রয়েছে। যেমন: তাপ উৎপাদন, দেহের ক্ষয়পূরণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন।
মৌটুসী আমড়া, পেয়ারা, কামরাঙ্গা খেতে পছন্দ করে, রবিনের পছন্দ মাছ, মাংস, মিষ্টি আর তুলির পছন্দ পাউরুটি, বিস্কুট, চিপ্স ইত্যাদি। এ খাবারগুলো ভিন্ন স্বাদ ও গুণাগুণের দিক থেকে আলাদা। স্বাদ ও গুণাগুণ বিচারে খাদ্যকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: শর্করা, প্রোটিন বা আমিষ, ও স্নেহজাতীয় খাদ্য। এ তিন প্রকার খাদ্য আমাদের দেহগঠন, ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন ও শক্তি জোগায়। এছাড়া খনিজ লবণ, ভিটামিন ও পানি হলো আরো তিন প্রকার খাদ্য উপাদান। এ উপাদানগুলো দেহকে রোগমুক্ত ও সবল রাখার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।
শর্করা
যেসব খাবারে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে তাকে শর্করা জাতীয় খাদ্য বলে। যেমন: চাল, আটা, ময়দা, ভুট্টা, চিনি, গুড় ইত্যাদি। কেবলমাত্র উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে আমরা শর্করা পেয়ে থাকি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা এ জাতীয় খাদ্যই বেশি খাই। আয়োডিন দ্রবণ ব্যবহার করে কোনো খাদ্যে শর্করা আছে কি না তা নির্ণয় করা যায়। শর্করা আয়োডিন দ্রবণের রঙের পরিবর্তন করে।

শর্করার কাজ
১. শর্করা সহজে হজম হয়, দেহের কাজ করার শক্তি জোগায় ও তাপ উৎপন্ন করে।
২. শর্করায় বিদ্যমান সেলুলোজ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
| কাজ: শর্করা চেনার উপায় পরীক্ষণের জন্য একটি টেস্টটিউবে অথবা কাচপাত্রে সামান্য পরিমাণে আটা গুলে নাও। মিশ্রণটি টেস্টটিউবে নিয়ে জ্বলন্ত স্পিরিট ল্যাম্পের উপর ধর। মিশ্রণটি গরম হলে, ঐ মিশ্রণে দুই ফোঁটা পাতলা আয়োডিন দ্রবণ ভালো করে মিশিয়ে নাও। |
দেখ কী ঘটে? মিশ্রণটিতে কোন পরিবর্তন লক্ষ করছ কী? মিশ্রণটি গাঢ় বেগুনি বর্ণ ধারণ করেছে। অতত্রব আটা শর্করা জাতীয় খাদ্য। মিশ্রণে বা খাদ্যে শর্করা থাকার কারণে আয়োডিনের রঙের পরিবর্তন ঘটেছে।
নতুন শব্দ: সেলুলোজ, কোষ্ঠকাঠিন্য ও প্রোটিন।
রহিম সাহেবের বড়ো ছেলে শাহিনের পছন্দ মাছ ও ডিম, আর ছোটো ছেলে কবিরের পছন্দ মাংস ও দুগ্ধজাত খাদ্য। এগুলো কী জাতীয় খাদ্য? এগুলো প্রোটিন জাতীয় খাদ্য। উৎসের উপর ভিত্তি করে প্রোটিনকে প্রাণিজ এবং উদ্ভিজ প্রোটিন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মাছ, মাংস, ডিম ও দুগ্ধজাত দ্রব্য প্রোটিনের উৎস প্রাণী, তাই এগুলো প্রাণিজ প্রোটিন। অপরদিকে ডাল, বাদাম, শিম ও বরবটির বীজ ইত্যাদির উৎস উদ্ভিদ, এগুলো উদ্ভিজ্জ প্রোটিন।
প্রোটিনের কাজ
১. প্রোটিনের প্রধান কাজ হচ্ছে দেহে বৃদ্ধির জন্য কোষ গঠন করা। যেমন- দেহের পেশি, হাড় বা অস্থি, রক্ত কণিকা ইত্যাদি প্রোটিন দ্বারা গঠিত।
২. দেহে শক্তি উৎপন্ন করা।
৩. দেহে রোগ প্রতিরোধকারী এন্টিবডি প্রোটিন থেকে তৈরি হয়।

শিশুদের খাদ্যে প্রোটিনের অভাব ঘটলে কোয়াশিয়রকর রোগ হয়। এ রোগের কারণে দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও গঠন বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুদেহের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হলে শিশু পুষ্টিহীনতা বা অপুষ্টিতে ভোগে।
| কাজ: একটি টেস্টটিউবে সামান্য পানি নাও। এর ভিতরে ডিমের সাদা তরল অংশ ঢেলে দাও। এবার মিশ্রণটি স্পিরিট ল্যাম্পের আগুনে গরম কর। |
তোমরা কী দেখতে পাচ্ছ? ডিমের সাদা অংশটি শক্ত হয়ে গেছে। তরল প্রোটিন উত্তাপে শক্ত হয়ে যায়। নতুন শব্দ: রক্তকণিকা, উদ্ভিজ্জ প্রোটিন ও প্রাণিজ প্রোটিন।
যেসব খাদ্যে তেল বা চর্বি জাতীয় উপাদান বেশি থাকে, এদেরকে স্নেহ জাতীয় খাদ্য বলে। প্রোটিনের মতো স্নেহ জাতীয় খাদ্য দুই প্রকার। মাছের তেল, মাংসের চর্বি, ঘি, মাখন ইত্যাদি প্রাণী থেকে পাই, এসব প্রাণিজ স্নেহ। সয়াবিন, বাদাম, সরিষা, তিল, জলপাই ইত্যাদির তেল উদ্ভিজ স্নেহ। মাংসের চর্বি, ঘি ও মাখন ইত্যাদি জমাট স্নেহ। সয়াবিন, সরিষা, তিল, জলপাই, বাদাম ইত্যাদির তেল তরল স্নেহ।
স্নেহ বা চর্বির কাজ
১. দেহের তাপ ও কর্মশক্তি বাড়ায়, ত্বকের নিচের চর্বিস্তরে দেহের তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করে।
২. দেহের প্রোটিনকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে।
৩. দেহে ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে-এর জোগান দেয়।

| কাজ: স্নেহ পদার্থ চেনার পরীক্ষণের জন্য এক টুকরো সাদা কাগজের উপর কয়েক ফোঁটা সয়াবিন তেল ফেলে কাগজের উপর ঘষে নাও। এবার আলোর দিকে কাগজটি ধর। কাগজের যে জায়গায় তেলের ফোঁটা ফেলা হয়েছে সে জায়গাটি স্বচ্ছ মনে হচ্ছে কী? |
কাগজের উপরের স্বচ্ছ জায়গাটির ভেতর দিয়ে সামান্য আলো প্রবেশ করছে। এটা তেল বা চর্বি চেনার একটি সহজ পদ্ধতি।
ক্যালরি কী?
১ গ্রাম পানির তাপমাত্রা ১০ সেলসিয়াস বাড়াতে প্রয়োজনীয় তাপ হচ্ছে ১ ক্যালরি। ১০০০ ক্যালরি = ১ কিলোক্যালরি। শর্করা, প্রোটিন ও স্নেহ জাতীয় খাদ্য উপাদান থেকে দেহে তাপ উৎপন্ন হয়। এই তাপ আমাদের দেহের ভিতরে খাদ্যের পরিপাক, বিপাক, শ্বাসকার্য, রক্তসঞ্চালন ইত্যাদি কাজে সাহায্য করে। শারীরিক পরিশ্রমে শক্তি ব্যয় হয়। খাদ্যে শক্তি সঞ্চিত থাকে। আমরা খাবার থেকেই শক্তি পাই। খাদ্যের তাপশক্তি মাপার একক হলো কিলোক্যালরি।
যেসব খাদ্যে শর্করা, প্রোটিন ও স্নেহ পদার্থ থাকে, সেসব খাদ্য থেকে বেশি ক্যালরি পাওয়া যায়। যেসব খাদ্যে পানি ও সেলুলোজের পরিমাণ বেশি থাকে, সেসব খাদ্যে ক্যালরির পরিমাণ কম থাকে। তেল বা চর্বি জাতীয় পদার্থে ক্যালরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে।
নিচের সারণিটি দেখ। এতে কয়েকটি উচ্চ ও নিম্ন ক্যালরিযুক্ত খাদ্যের তালিকা দেখানো হলো:
উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাদ্য | নিম ক্যালরিযুক্ত খাদ্য |
ভোজ্যতেল | চাল কুমড়া |
ঘি | বাধাকপি |
মাখন | ঝিঙা |
মাছের তেল | শালগম |
ঘন নারকেলের দুধ | টমেটো |
মাখন তোলা গুঁড়া দুধ | ডাঁটা |
ভাজা চিনা বাদাম | লাউ |
চিনি | পালংশাক |
মধু | কলমি ডাঁটা |
খেজুরের গুড় | মূলা |
ছোলার ডাল | ওলকপি |
সয়াবিন | ধুন্দল |
শিমের বিচি | পটল |
প্রতিদিন কার কত ক্যালরি বা তাপশক্তি প্রয়োজন তা নির্ভর করে প্রধানত বয়স, ওজন, দৈহিক উচ্চতা ও পরিশ্রমের ধরনের উপর।
| কাজ: তোমার এলাকায় পাওয়া যায় এমন সব কম ক্যালরিযুক্ত ও বেশি ক্যালরিযুক্ত খাবারের নমুনা ও তালিকার একটি চার্ট তৈরি কর। |
নতুন শব্দ: ক্যালরি, প্রাণিজ স্নেহ ও উদ্ভিজ্জ স্নেহ।
খাদ্যে অতি সামান্য মাত্রায় এক প্রকার জৈব পদার্থ আছে, যা প্রাণীর স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয়। এই প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থগুলোকে খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন বলে। আমরা প্রতিদিন যেসব খাদ্য (যেমন-চাল, আটা, বাদাম, ডাল, শাকসবজি, ফলমূল) খাই এর মধ্যেই ভিটামিন থাকে। ভিটামিন আলাদা কোনো খাদ্য নয়।
অনেক দিন ধরে দেহে কোনো ভিটামিনের অভাব ঘটলে নানা রকম রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। ভিটামিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করে নানা রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

আমাদের দেহে ভিটামিনের ভূমিকা অপরিহার্য।
আমাদের প্রয়োজনীয় ভিটামিনগুলোর একটি তালিকা পরের পৃষ্টায় দেওয়া হলো। ছকে যে সমস্ত খাদ্যে ভিটামিন আছে তাদের নাম, উৎস, ভিটামিন গুলোর প্রয়োজনীয়তা ও বিবরণ দেওয়া হলো।
ভিটামিন | খাদ্যের উৎস | প্রয়োজনীয়তা |
ভিটামিন-এ দেহে জমা থাকে | কলিজা, ডিম, মাখন, পনির, মাছ, টাটকা সবুজ শাকসবজি, গাজর, আম, কাঁঠাল ও পাকা পেঁপে। | দেহের বৃদ্ধি, দৃষ্টিশক্তি ও রোগ প্রতিরোধে। |
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স (বেশ কয়েকটি ভিটামিন একত্রে গঠিত। দেহে জমা থাকে না।) | ডিম, কলিজা, বৃক্ক, মাংস, দুধ, গম, লাল চাল, পনির, শিম ও বাদাম। | দেহের বৃদ্ধি, হৃদপিণ্ড, স্নায়ু এবং পরিপাক ব্যবস্থার সুষ্ঠু কাজ সম্পাদনে, চামড়ার স্বাস্থ্য রক্ষায়। |
ভিটামিন-সি রন্ধনে অথবা মজুদ রাখলে নষ্ট হয়ে যায়। | লেবু, কমলা, আমলকী, পেয়ারা, জাম্বুরা, টমেটো, কচুশাক, কলমিশাক ও সবুজ শাক-সবজি। | সুস্থ-সবল হাড়, দাঁত, দাঁতের মাড়ি ও মুখের ক্ষত সারাতে। |
ভিটামিন ডি (দেহে জমা থাকে) | দুধ, মাখন, ডিম এবং মাছের তেল (সূর্যের আলোতে আমাদের শরীরের চামড়া এই ভিটামিন তৈরি করতে পারে)। | দেহকে ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস ব্যবহারে সাহায্য করে বা সুস্থ-সবল হাড় ও দাঁত গঠনে প্রয়োজন। |
নতুন শব্দ: ভিটামিন ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স।
রহিমন গলগণ্ড, সাহিদা রক্তাস্বল্পতায় ভুগছে- এরা কেন এসব রোগে ভুগছে? খনিজ লবণের অভাবে তাদের দেহে এসব রোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভাত ও তরকারির সাথে আমরা লবণ খাই। তাছাড়াও আমাদের দেহের জন্য আরও কয়েক প্রকার লবণ প্রয়োজন হয়। দেহ কোষ ও দেহের তরল উপাদানের জন্য (যেমন- রক্ত, এনজাইম, হরমোন ইত্যাদি) খনিজ লবণ খুবই দরকারি। খনিজ লবণ দেহ গঠন, দেহের অভ্যন্তরীণ কাজ (যেমন- পেশি সংকোচন, স্নায়ু উত্তেজনা) নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। হাড়, এনজাইম ও হরমোন গঠনের জন্য এটি একটি অপরিহার্য উপাদান।
উদ্ভিদ মাটি থেকে সরাসরি খনিজ লবণ শোষণ করে। আমরা প্রতিদিন যে শাকসবজি, ফলমূল খাই এ থেকে আমরা প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ পেয়ে থাকি। আমাদের দেহের ওজনের ১% পরিমাণ লবণ থাকে। এ উপাদানগুলো হলো ফসফরাস, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, সালফার, সোডিয়াম, ক্লোরিন ও ম্যাগনেসিয়াম। এছাড়া লোহা, আয়োডিন, দস্তা, তামা ইত্যাদি খনিজ লবণ আমাদের দেহের জন্য অতি সামান্য পরিমাণে দরকার। এগুলোর অভাব ঘটলে দেহে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড রোগ হয়। খাবার লবণের সাথে আয়োডিন মিশিয়ে আয়োডাইড লবণ তৈরি করা হয়। গলগণ্ড রোধে আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া উচিত।
গুরুত্বপূর্ণ খনিজ লবণগুলো নিচের ছকে দেওয়া আছে। কোন কোন খাদ্যে এগুলো পাওয়া যায় এবং এদের প্রয়োজনীয়তার বিবরণও এই ছকে আছে।
খনিজ লবণ | খাদ্যের উৎস | প্রয়োজনীয়তা |
ক্যালসিয়াম | দুধ, মাংস ও সবুজ শাকসবজি। | দাঁত ও হাড়ের সুস্থতায়, রক্ত জমাট বাঁধতে ও স্নায়ু ব্যবস্থার সুষ্ঠু কাজ সম্পাদনে সহায়তা করে। |
ফসফরাস লবণ | দুধ, মাংস, ডিম, ডাল ও সবুজ শাকসবজি। | সুস্থ দাঁত ও হাড়ের জন্য। |
লোহা | মাংস, ফল ও সবুজ শাকসবজি। | রক্তের লালকণিকা বৃদ্ধি করে রক্তস্বল্পতা দূর করে। |
আয়োডিন | সামুদ্রিক শৈবাল, সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেল। | থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে গলগণ্ড রোগ মুক্ত রাখে। |
সোডিয়াম | সাধারণ লবণ, নোনা ইলিশ, পনির ও নোনতা বিস্কুট। | দেহের অধিকাংশ কোষে এবং দেহরসের জন্য এর স্বল্পতা দেহে আড়ষ্ট ভাব আনে। |
ম্যাগনেসিয়াম | সবুজ শাকসবজি। | এনজাইম বিক্রিয়া ও দাঁতের শক্ত আবরণ গঠনে ভূমিকা রাখে। |
ক্লোরিন | খাবার লবণ | দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তৈরি করা। |
পটাসিয়াম | মাছ, দুধ, ডাল, আখের গুড় ও শাকসবজি। | পেশি সংকোচনে ভূমিকা রাখে। |
পানি
পানি খাদ্যের একটি অপরিহার্য উপাদান। জীবন রক্ষার কাজে অক্সিজেনের পরই পানির স্থান। খাদ্য ছাড়া মানুষ কয়েক সপ্তাহ বাঁচতে পারে, কিন্তু পানি ছাড়া কয়েক দিনও বাঁচতে পারে না। আমাদের দেহের দুই-তৃতীয়াংশ হলো পানি।
পানি দেহের গঠন, অভ্যন্তরীণ কাজ (যেমন- খাদ্য গলাধঃকরণ, পরিপাক ও শোষণ ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণ করে। পানি দেহে দ্রাবক রূপে কাজ করে। বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, খাদ্য উপাদান পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। পানির কারণে রক্ত তরল থাকে, যা রক্ত সঞ্চালনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পানি দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখে। পানির আরও একটি প্রধান কাজ হলো মলমূত্রের সাথে ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণ করা। পানির অভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়, বিপাক ক্রিয়া ও রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটে। তাই আমাদের নিয়মিত পরিমাণ মতো নিরাপদ পানি পান করা প্রয়োজন।
রাফেজ: শস্যদানা, ফল ও সবজির কিছু অংশ যা হজম বা পরিপাক হয় না এমন তন্ত্রময় বা আঁশযুক্ত অংশ রাফেজ নামে পরিচিত। ফল ও সবজির রাফেজ সেলুলোজ নির্মিত কোষ প্রাচীর ছাড়া আর কিছুই নয়। রাফেজ হজম হয় না। রাফেজ পরিপাকের পর অপরিবর্তিত থাকে। এই অপরিবর্তিত রাফেজ মানবদেহে মল তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
নতুন শব্দ: রাফেজ ও এনজাইম।
জয়া ও জিতু দুই বন্ধু। ওরা দুজনই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। জয়া শুকনা, পাতলা গড়নের, দুর্বল ও পড়ালেখায় অমনযোগী। সবসময় ওকে মনমরা দেখায়। প্রায়ই অসুস্থতার কারণে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। জিতু একদিন জয়াদের বাড়িতে বেড়াতে গেল। সে জয়ার মায়ের কাছ থেকে জানতে পারল জয়া নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করে না। সে যেটুকু খাবার খায় তাতে ভাত, মাছ ও মাংসের পরিমাণ থাকে সামান্য। ডিম, দুধ, ফল-মূল ও শাকসবজি একেবারেই খায় না। মা জোর করেও ওগুলো তাকে খাওয়াতে পারেন না। মা ওকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাহলে বল তো জয়ার খাবার তালিকাটি কী সঠিক? সে শর্করা ও প্রোটিন জাতীয় খাবার খায় সামান্য পরিমাণ। অন্যান্য খাবার না খাওয়ায় ওর দেহে ভিটামিন, খনিজ লবণ ও অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ ওর খাবার তালিকাটি সুষম নয়। কারণ যে খাবার তালিকায় সব কয়টি খাদ্য উপাদান থাকে না, সেটি সুষম খাদ্যের তালিকা নয়।
সুষম খাদ্য বলতে আমরা কী বুঝি? সুষম খাদ্য বলতে আমরা সেই সকল খাবার বুঝি, যাতে প্রয়োজনীয় সকল খাদ্য উপাদান পরিমাণ মতো থাকে। অর্থাৎ প্রোটিন, শর্করা, চর্বি, ভিটামিন ও পানি দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে থাকে। সুষম খাদ্য খেতে হলে আমাদের খাদ্য তালিকায় শর্করা, প্রোটিন, তেল বা চর্বি জাতীয় খাদ্য, ভিটামিন ও খনিজ লবণের উপাদান থাকা আবশ্যক।
জয়া যে খাবার খাচ্ছে তা সুষম না হওয়ায় দেহের বৃদ্ধি ঘটছে না, কাজে শক্তি পায় না। দুর্বল বোধ করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশ কম। স্বাভাবিক বৃদ্ধি, কর্মশক্তি উৎপাদন ও শরীরকে রোগমুক্ত রাখার জন্য আমাদের নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।
অসুষম খাদ্য: খাদ্য তালিকায় ছয়টি খাদ্য উপাদানের যে কোনো একটি কম থাকলে বা না থাকলে তাকে অসুষম খাদ্য বা অসম খাদ্য বলে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ লোকের খাদ্যই অসম। সাধারণ মানুষের খাদ্যের প্রায় সম্পূর্ণটাই শর্করা। খাদ্যে প্রোটিন, শর্করা, খনিজ লবণ এবং ভিটামিন পরিমাণের চেয়ে কম থাকলে দেহে পুষ্টির অভাব ঘটে। অর্থাৎ দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবকে অপুষ্টি বা পুষ্টিহীনতা বলে থাকি।
স্বাস্থ্যকর সুষম খাদ্য খাওয়ার জন্য নিম্মলিখিত বিষয়গুলো মনে রাখা প্রয়োজন। যথা-
- শর্করা জাতীয় খাদ্য বেশি খেতে হবে।
- যথেষ্ট পরিমাণ শাকসবজি খেতে হবে।
- মাছ বেশি খেতে হবে।
- মিষ্টি ও তেল বা চর্বি জাতীয় খাবার কম খেতে হবে।
- লবণ কম খেতে হবে।
| কাজ: শিক্ষার্থীরা দলগত ভাবে স্থানীয় সহজলভ্য বিভিন্ন খাদ্য সংগ্রহ করবে। সংগৃহীত খাদ্য উপাদানগুলো শ্রেণিতে প্রদর্শন করবে। এগুলোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে। |
এ অধ্যায়ে আমরা যা শিখলাম
- খাদ্য তিন প্রকার।
- খাদ্য উপাদান ছয় প্রকার।
- ভিটামিন ও খনিজ লবণ আলাদা কোনো খাদ্য নয়। এ উপাদানগুলো শাকসবজি ও ফলমূলের মধ্যে থাকে।
- অতিরিক্ত প্রোটিন বা শ্বেতসার খাওয়া উচিত নয়।
- সুষম খাদ্য আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজন।
- খাদ্যের তাপশক্তি মাপার একক কিলোক্যালরি। প্রতিদিন কার কত তাপশক্তি বা ক্যালরি প্রয়োজন তা নির্ভর করে বয়স, ওজন, দৈহিক উচ্চতা ও পরিশ্রমের ধরনের উপর।
Read more